জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা এ-ও বলেছিলাম যে জামায়াতে ইসলামীর ভারতে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নামের আগে ‘মওলানা’ ছিল। তিনি তো গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে শরিক হওয়ার জন্য। তিনি ভারত ছেড়ে বাধ্য হয়েছেন আবার পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকতে। তার ‘মওলানা’ নামটাকে সহ্য করা হয়নি। আর জামায়াতে ইসলামীর মতো দলকে ভারত মুক্তিযুদ্ধ করার সুযোগ দিতো এটা কোনো বোকা স্বপ্নেও ভাববে না এবং কেউ বলবেও না।’
তিনি আরও বলেন, ‘তাহলে জামায়াত কী করবে? জামায়াত ছিল বাংলাদেশে। তখনও পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে ছিল। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলেও সবার বেতন পাকিস্তান সরকার থেকেও হতো। সুতরাং সেসময় শুধু জামায়াত না, যারাই এই যুদ্ধকে দীর্ঘকালীন সংকট মনে করতো তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। তারা সবাই ছিল এক পাকিস্তান রাখার পক্ষে এবং এটা শেখ মুজিব সাহেবও চেয়েছিলেন।’
দেশের এক বেসরকারি টেলিভিশনকে সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ জামায়াতের ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান এসব কথা বলেছেন।
জামায়াতের এই আমির বলেন, ‘শেখ মুজিব সাহেব কীসের সংলাপ করেছিলেন হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে ভুট্টু ও ইয়াহইয়া খানের সঙ্গে? তিনি কি ডায়ালগ করেছিলেন? শান্তিতে কীভাবে দেশ স্বাধীন হয়? সেই মেসেজ তো জাতির সামনে আজও কেউ উপস্থাপন করতে পারলো না। তিনি তো ডায়ালগ করেছিলেন তার হাতে তার দলের হাতে ক্ষমতা দেয়ার জন্য। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি তো স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য গ্রেফতার হননি।’
তিনি বলেন, ‘শেখ মুজিবের সহযোগী তাজউদ্দীন ড্রাফট করে নিয়ে গিয়েছিলেন স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার জন্য। শেখ মুজিব বলেছিলেন, তোমরা কি আমাকে আবার রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় দাঁড় করাতে চাও? তো আমাদের যে অবস্থান ছিল শেখ মুজিব সাহেবের একই অবস্থান ছিল।’
জামায়াতের সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা তখন চেয়েছিলাম যদি দেশ স্বাধীন করতে হয় তাহলে বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের পূর্ণশক্তিতে স্বাধীন করতে হবে। তাহলে মানুষ স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল লাভ করবে। আমাদের আশঙ্কার যে জায়গা ছিল, ৫৩ বছর কী তার প্রমাণ করলো? এখন তো লোকেরা বলে আপনারা যে আশঙ্কা করেছিলেন এখন তো তার চাইতেও খারাপ।’
তিনি বলেন, “একটা স্বাধীন দেশে আরেকটা দেশের পররাষ্ট্র সচিব এসে বলে কোন দল ইলেকশনে যাবে আর কোন দলে যাবে না। কে কার সাথে অ্যালাইন্স করবে; কে সরকার গঠন করবে। এটা কি আরেকটা দেশের কাজ? এভাবে যদি হয় তাহলে একটা দেশের স্বাধীনতার মর্যাদাবোধটা কোথায় থাকে? ফারাক্কা বাঁধ হলো, তিস্তা চুক্তির সমাধান হলো না, ফেলানি শেষ পর্যন্ত কোনো ন্যায় বিচার পেলো না। আমরা এসবেরই আশঙ্কা করেছিলাম।”
‘আমরা (জামায়াত) স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিলাম না। আমরা আশঙ্কা করেছিলাম, ভারতের সহযোগিতায় যদি দেশ স্বাধীন হয় তাহলে স্বাধীনতার সুফল পাওয়া যাবে না।’
জামায়াতের আমির আরও বলেন, এরপরেও এটা সঠিক যে- জামায়াত চেয়েছিল এক পাকিস্তান। কিন্তু পরবর্তীতে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তাদের নিপীড়ন, নির্যাতন, খুন এবং বিভিন্ন ধরণের অপকর্মের কারণে সারা জাতি ফুঁসে উঠেছিল, মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। সেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশকে আমরা আমাদের কলিজা দিয়ে ভালোবেসে কবুল করে নিয়েছি।
আমির বলেন, তখনকার সময়ে আমাদের চিন্তা বিজয়ী হয়নি, সেই সময় আমাদের চিন্তা পরাজিত হয়েছে, আমাদের সিদ্ধান্ত পরাজিত হয়েছে। এখন জনগণ মূল্যায়ন করবে আমাদের সেই ভূমিকা কতটা যথার্থ ছিল।
সর্বশেষ শেখ হাসিনা দেশত্যাগের কয়েকদিন আগে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল দলটিকে। এ নিয়ে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় যায় তখন নিষিদ্ধের ঘোর তাদের পেয়ে বসে। নিষিদ্ধের রাজনীতি আমাদের সমর্থনের বিষয় না। এটি জনগণের আকাঙ্ক্ষার বিষয়।
সম্প্রতি বিএনপি ও জামায়াতের নেতাদের বক্তব্যে দল দুটির মধ্যে দূরত্বের বিষয়টি সামনে এলেও তা মানতে নারাজ জামায়াতের আমির। তিনি বলেন, যৌক্তিক সময়ের মধ্যে মৌলিক সংস্কার করা সব সংস্কার নয়। কিছু সংস্কার করবে অন্তর্বর্তী সরকার আর কিছু সংস্কার করবে নির্বাচিত সরকার। আমরা মনে করি নৈতিক দায়বদ্ধতা আছে বর্তমান সরকারের। তারা তাড়াহুড়া নেই বলে এই বিষয়টি টেনে লম্বা যেনো না করে এই কথা আমরা বারবার বলেছি।
অন্তর্বর্তী সরকার থেকে জামায়াত বেশি সুবিধা পাচ্ছে এমন অভিযোগও উড়িয়ে দেন ডাক্তার শফিকুর রহমান। তবে সংস্কারের জন্য দিতে চান যৌক্তিক সময়।
প্রসঙ্গত, স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনীতি কঠিন হলেও গত দেড় দশকে অনেকটাই কোণঠাসা ছিল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে দলটির শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি দেওয়া থেকে শুরু করে শেষ সময়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা। সব মিলিয়ে বেশ কায়দা করেই রাজনীতির মাঠে টিকে থাকতে হয়েছে দলটির নেতা-কর্মীদের।
সালাউদ্দিন/সাএ