পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন হয় ২০১০ সালে। এরপর আইনের অধীনে করা ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার বিধিমালা, ২০১৩’ অনুযায়ী ধান, চাল, গমসহ পর্যায়ক্রমে ১৯টি পণ্যের মোড়কীকরণে পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। এটি বাস্তবায়নে বিভিন্ন সময় পরিচালনা করা হয় অভিযান। সফলতাও আসে। অধিকাংশ পণ্যের মোড়কে নিশ্চিত হয় পাটের ব্যবহার।
কয়েক বছর ধরে আইন প্রয়োগের শিথিলতায় এসব পণ্যের মোড়কে ফের ফিরেছে প্লাস্টিক। এখন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ধান, চালসহ অন্য পণ্যের মোড়কে বেড়েছে প্লাস্টিকের বস্তা। সরকারি বিধিমালা অনুযায়ী ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার, চিনি, মরিচ, হলুদ, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, ডাল, ধনিয়া, আলু, আটা, ময়দা, তুষ-খুদ-কুঁড়া, পোল্ট্রি ফিড ও ফিশ ফিড মোড়কীকরণে পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক।
আরও পড়ুন>> ‘পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক সদিচ্ছাই যথেষ্ট’
গরিব চাষির পাটের উৎপাদন নিশ্চিত করা, পাটের বহুমুখী ব্যবহার ও সম্প্রসারণ এবং পরিবেশ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ২০১০ সালে পণ্যের মোড়কীকরণে পাটের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন প্রণয়ন করা হয়। আইন অনুযায়ী, পাটের মোড়ক ব্যবহার না করলে সর্বোচ্চ শাস্তি এক বছরের জেল অথবা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড।
আইনটি বাস্তবায়নের বড় একটি পক্ষ চালকলগুলো। চালকল মালিকরা জানান, সরকার চালসহ বিভিন্ন পণ্য পলিথিনের বস্তায় আমদানি করে। আমদানি করতে পারলে মিলাররা প্লাস্টিকের বস্তায় চাল সরবরাহ করলে দোষ কোথায়!
পাটের বস্তার চেয়ে প্লাস্টিকের বস্তা সাশ্রয়ী। তাই মিল মালিকদের মধ্যে পাটের বস্তা ব্যবহারে অনাগ্রহ বলে জানা যায়। পলিথিন নদী দূষণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় জটিলতা সৃষ্টি, জলাবদ্ধতা তৈরিসহ সামগ্রিকভাবে পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ। পলিথিন অপচনশীল হওয়ায় মাটির উর্বরতা নষ্ট করে। অব্যবহৃত পলিথিন পোড়ালে বিষাক্ত কার্বন মনো অক্সাইড তৈরি হয়, যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিবেচনা করে বাংলাদেশে ২০০২ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর পরিপ্রেক্ষিতে পলিথিনের ব্যাগ উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন এবং পরিবহন নিষিদ্ধ করা হয়। পরবর্তীসময়ে প্লাস্টিকের বস্তার পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব পাটের বস্তা চালুর উদ্যোগ নেয় সরকার।
পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন বাস্তবায়নে ২০১৫ সালে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। ওই সময় প্রতিটি জেলা, উপজেলায় ধান, চাল, গম, ভুট্টা, চিনি, সারসহ নির্ধারিত পণ্যবাহী যানবাহনসহ সব জায়গায় মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এরপর ২০১৭ সালেও বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হয়। পরে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হলেও মূলত সেভাবে নজরদারি ছিল না। এ সুযোগে প্লাস্টিকের বস্তা বিস্তৃতি লাভ করেছে।
আরও পড়ুন>> দূষণ বাড়ে বাজেট কমে পরিবেশের
পাট মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এক সময় সক্রিয় তদারকির মাধ্যমে নির্ধারিত পণ্যে পাটের মোড়কের ব্যবহার ৮০-৯০ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এখন পাটের মোড়কের ব্যবহার অনেক কমে গেছে, সেখানে প্লাস্টিকের বস্তা দখল করে নিয়েছে। এখন পাটের বস্তা ব্যবহারের পরিমাণ ৫০ শতাংশেরও নিচে। পাটের বস্তার পরিবর্তে ব্যবসায়ীরা পাটের পণ্য সরবরাহ ও সংরক্ষণে পাটের বস্তার ব্যবহার না করার জন্য নানা ফাঁক-ফোকর বের করেছেন। পাটের মোড়ক ব্যবহার না করার জন্য অনেকে মামলা-মোকদ্দমাও করেছেন।
চলমান পরিস্থিতিতে বিষয়টিতে নজর দিচ্ছে সরকার। গত ২ মে পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন বাস্তবায়ন নিয়ে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর সভাপতিত্বে সভা হয়। এরপর ১০ মে আইনটি বাস্তবায়নে চালকল মালিক ও আড়তদারদের নিয়ে সভা করেন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুর রউফ।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুর রউফ ক্যাম্পাসনিউজকে বলেন, ‘দিনাজপুর, রাজশাহী, ফরিদপুর, নওগাঁওসহ বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে এসেছি। এখন এনফোর্সমেন্ট হচ্ছে না, তা নয়। কিন্তু একটা জিনিস শুরু হবে তখন যতটা কার্যকরভাবে করা যায়, সময় গেলে মানুষ ফাঁক-ফোকর বের করে সুবিধা নিতে চায়। পাটের মোড়ক ব্যবহার না করার জন্য কমপক্ষে ডজনখানেক মামলা হয়েছে। একটা মামলা হলে সেটা নিষ্পত্তি হতে অনেক সময় লাগে। তখন তো আমাদের কিছু করার থাকে না, তাদের টাচ করতে পারি না। একটি মামলা শেষ হলে আবার আরেকটি করে। আমরা কমপক্ষে একডজন রিটের রায় পক্ষে পেয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘প্রথম যখন আইনটি বাস্তবায়ন করা হয়, তখন তো মামলাসহ এসব কায়দা-কানুন বের হয়নি। তাই কাজটি সঠিকভাবে হয়েছে। এ মামলাগুলো যেহেতু আইনবিরোধী, তাই এগুলো আমরা মোকাবিলা করছি।’
আরও পড়ুন>> পরিবেশ দূষণের জন্য প্রধানত ব্যবসায়ীরাই দায়ী: মনজিল মোরসেদ
‘বিভিন্ন পণ্যের মোড়কে পাটের ব্যবহার নিশ্চিতে আমাদের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সেগুলো মেনেই আমরা কাজ করছি। পাটের মোড়ক ব্যবহারের হার কোথাও হয়তো কম, আবার কোথাও হয়তো বেশি। এনফোর্সমেন্টের জন্য মন্ত্রী (বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী) মহোদয়ের নেতৃত্বে সভা করা হয়েছে। আমি চালকল মালিকদের সঙ্গে মিটিং করেছি। আমাদের চেষ্টা আছে।’
সচিব বলেন, ‘কোনো কোনো ব্যবসায়ী বলেন, আমরা তো পাটের বস্তা পাচ্ছি না। কিন্তু ক্রেতার অভাবে পাটকলগুলোর উৎপাদন কমে যাচ্ছে। পাটের বস্তা ব্যবহার না করার জন্য ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাত ও ফাঁক-ফোঁকর বের করেছেন। তারা আন্তরিকভাবে কাজটি করতে না চাইলে এটি বাস্তবায়ন করা কঠিন।’
তিনি আরও বলেন, ‘ফিশ ফিডের ক্ষেত্রে পাটের বস্তা ব্যবহারের বিষয় থাকলেও সেখানে ময়েশ্চারের (আর্দ্রতার) বিষয় আছে। এতে পাটের বস্তায় রাখা সুবিধাজনক নয়। এসব জায়গায় তো আমরা সেভাবে এনফোর্স করতে পারছি না। আমি চাল ও পেঁয়াজ যদি আমদানি করে সেখানে তো তাদের পাটের বস্তায় সরবরাহের কন্ডিশন দিতে পারছি না। আবার কেউ কেউ বিদেশ থেকে প্লাস্টিকের বস্তায় চাল এনে পরে আবার সেটা ব্যবহার করে।’
আব্দুর রউফ বলেন, ‘সব বিষয় বিবেচনায় এনে আমাদের অফিসাররা কাজ করছেন। এটি বাস্তবায়ন করবে আমাদের পাট অধিদপ্তর। তাদের মাঠ পর্যায়ের ৪০০-৫০০ কর্মকর্তার পদ খালি। সেখানে একের পর এক মামলার কারণে লোকবল নিয়োগ দেওয়াও যাচ্ছে না। ডিসিদের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার জন্য বলা হচ্ছে।’
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি কে এম লায়েক আলী ক্যাম্পাসনিউজকে বলেন, আমদানির চাল কি কোনোটা পাটের বস্তায় আসছে? তাহলে এক দেশে দুই আইন কীভাবে হয়। আপনি আরেকজনকে যে সুযোগ দেবেন, আমিও সেই সুযোগ চাই। প্লাস্টিকের বস্তায় চাল আনবেন আমাকে বলবেন পাটের বস্তায়, আমাদের অপরাধ কোথায়। তারপরও আমাদের জরিমানা করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বারবার আইনটি সংশোধনের জন্য বলছি। আটা, ময়দা থেকে শুরু করে কোন জায়গায় পাটের বস্তা আছে? তাহলে চালে কেন? চালের কী অপরাধ? আমাদের অপরাধ আমরা মিলার?’
আরও পড়ুন>> ‘পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে সবুজ কর আরোপ ও প্রণোদনা বিবেচনাধীন’
হাসকিং মিল মালিক সমিতির এক নেতা বলেন, পাটের বস্তার দাম বেশি হওয়ায় চাল উৎপাদনকারীদের জন্য পাটের বস্তা ব্যবহার করা কঠিন হচ্ছে। ছোট ছোট হাসকিং মিলে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করায় পাটের বস্তার ব্যবহার বন্ধের উপক্রম হয়েছে। অনেক মিলে রপ্তানি করা চালে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের ব্যাগ ও সিল নকল করে দেশি চাল ভর্তি করে বাজারে ছাড়া হচ্ছে। প্লাস্টিক বস্তার ব্যবহার বন্ধ ও পাটের বস্তার ব্যবহার বাড়াতে নিরপেক্ষভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হচ্ছে না। তিনি নিরপেক্ষভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে পাট অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়মিত সভা করার অনুরোধ করেন।
গত ২ মে সভার কার্যপত্র থেকে জানা যায়, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী ওই সভায় বলেন, বর্তমান টেকসই উন্নয়নের যুগে বিশ্বের অনেক দেশই পরিবেশবান্ধব পাট ও পাটপণ্যের চাহিদা কাজে লাগাতে চেষ্টা করছে। সেখানে দেশে পাটপণ্য ব্যবহারে শিথিলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটি অনভিপ্রেত। এখন আইন অনুযায়ী ধান, চাল, গম, ভুট্টা, ডাল, আটা, ময়দাসহ ১৯ ধরনের পণ্য সংরক্ষণ, সরবরাহ ও মোড়কীকরণে পাটের বস্তার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
মন্ত্রী পাট অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, আইন অনুযায়ী ১৯ পণ্যে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক। এসব পণ্যে কেউ প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহার করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে। সারা বছর অভিযান চলমান থাকলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়- পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইনের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ ও সমন্বয় করতে হবে।
১০ মে অনুষ্ঠিত সভার কার্যপত্র থেকে জানা যায়, ওই সভায় সচিব বলেন, বর্তমানে পাটের বস্তার ব্যবহারে শিথিলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের বস্তা, পলিথিন ব্যবহৃত হচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। পলিথিন ব্যবহার করা হলে ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
ওই সভায় সমন্বয় করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনে পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন, ২০১০ আইন অনুযায়ী জেল-জরিমানা এবং উভয় দণ্ড কার্যকর করতে হবে বলেও সিদ্ধান্ত হয়।
আরএমএম/এএসএ/জিকেএস