আমাদের প্রজন্ম একদম বখে গেছে, ওদের দিয়ে কিছুই হবে একদম, একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা প্রজন্মের। পরবর্তী প্রজন্মকে একটা অন্ধকার প্রজন্ম মনে করেছিলাম আমরা সবাই। এই বিষয়ে কারো যেন দ্বিমত ছিল না। আমরা বারবার বলে গেছি, ওরা মোবাইলের মধ্যে সীমাবদ্ধ, ওরা ফেসবুক প্রজন্ম, ওরা টিকটক প্রজন্ম, ওরা পাবজি প্রজন্ম। কিন্তু ফলাফল, আজ আমাদের প্রজন্ম আমাদের সবাইকে ভুল প্রমাণ করেছে। আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, যে আমরাই আসলে পিছিয়ে ছিলাম, আমাদের দেখার চক্ষু আসলেই ভুল ছিল। আমরা চোখের সামনে এক ঝাপসা চশমা রেখে দিয়েছিলাম, আমরা জানিনি যে আমাদের ঘরে ঘরে এক সোনার প্রজন্ম গড়ে উঠেছে। এই প্রজন্মকে অনেকেই অনেক নাম দিচ্ছেন। কিন্তু আমি এই প্রজন্মকে নাম দিতে চাই পুনর্গঠন প্রজন্ম, ইংরেজিতে যেটাকে বলে reconstruction!
কেন আমি এটাকে reconstruction বললাম, সেই ব্যাখ্যায় পরে যাচ্ছি। আগে প্রজন্মের প্রতি আমাদের ভুল ধারণা আর আমাদের দায় নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। আমরা কি আমাদের প্রজন্মকে সবুজ পৃথিবী উপহার দিয়েছি? আমরা কি তাদের খেলার মাঠ দিয়েছি? আমরাই তো সবুজের সমারোহ কেটে কেটে ওদের উপহার দিয়েছি কংক্রিটের দেয়াল! আমরা খাওয়ানোর জন্য ওদের হাতে তুলে দিয়েছি মোবাইল। মোবাইলের মাঝে তো দুনিয়া আছে, খেলাটা এখানেই ঘটেছে! ওদের হাতের মুঠোয় দুনিয়া এসে গেছে। আমরা সিনেমা বলতে যা জানি ওরা সেটা জানে না, ওরা ক্রিস্টোফার নলেন চেনে, ওরা কঠিন কঠিন সব সমস্যা সমাধান করা শিখেছে ওই মোবাইলের মাঝে, ইন্টারনেট ওদের পৌঁছে দিয়েছে বিশ্বের দরবারে।
যারা আমাদের দেশ চালায়, তারা নিজেদের দাম্ভিকতা, ঔদার্যবোধের কারণে নিজেদের চিন্তার বাহিরে কিছুই ভাবতে পারেনি, তারা কখনো বুঝতে চেষ্টা করেনি এই প্রজন্ম কী চায়! তাই ওদের ফেসবুকের টাইমলাইন, কমেন্টবক্স দিয়ে ওদেরকে যাচাই করেছে অনেকে, অকপটে বলে দিয়েছে, ওদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না। কিন্তু ওদেরকে সবাই যখন হিসাবের বাহিরে নিয়ে গেছে, তখন ওদের দ্বারাই বিপ্লব ঘটেছে। মূলত আমাদের দেশটা মুখে মুখে অনেক এগিয়েছে, বাস্তবতা আসলে অনেক কঠিন, বাস্তবতার নিরিখে চিন্তা করতে গেলে আমরা পিছিয়ে আছি সকল দিকেই! জীবনের গুণগত মান থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রেই আমরা পিছিয়ে আছি। আমরা সেসব নিয়ে মাথা না ঘামালেও ওরা সেসব দেখেছে, ওই যে মোবাইল ফোনেই। আমরা যে বয়সে একটা বাটন ফোন কেনার সাহস পায়নি ওরা সেই বয়সে জুমে ক্লাস করে! যুগের চাহিদাই হয়তো এর বড় কারণ। কিন্তু যারা সহজেই হাতের নাগালে সব পেয়ে যাচ্ছে, তাদেরকে বুঝতে ভুল করলে তো চলবে না।
বাংলাদেশের বর্তমান ছাত্রসমাজ পুরো দেশটাকে একটা বিন্দুতে জড়ো করেছে। একটা বিন্দুতে জড়ো করার জন্য সবচেয়ে বড় যে জিনিসটা কাজ করেছে সেটা হচ্ছে ওদের মনের মিল। চিন্তায় চেতনায় মনে মননে ওরা সব এক! ওরা দুর্বার, দুর্বীনিত! ওদের আছে লড়াই করার শক্তি। ওরা যেমন দুষ্টুমি করতে পারে আবার দুষ্টু লোকের ঘুম হারাম করেও দিতে পারে।
একটা জিনিস দেখতে হবে খেয়াল করে, এই আন্দোলন আমাদের অনেক শিক্ষা দেয়। আমরা কী ভেবেছিলাম? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের আঘাত করলে, হল বন্ধ করলে আন্দোলন শেষ হয়ে যাবে! কিন্তু তা হলো না, পরের দিন রাস্তায় নেমে গেল সব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। যাদেরকে আমরা অনেকেই ফার্মের মুরগী বলি, তারাই দেখিয়েছে বাঘের আচরণ। আসলে আমরা ওদের মনের মাঝে ঢুকিনাই।
কী মনে হয়েছিল! এতগুলো ছাত্র মারা গেল, ওরা নিশ্চয়ই থেমে যাবে, দমে যাবে, ওরা দমেনি, ফিরে এসেছে দ্বিগুণ শক্তিতে, ওরা গ্রেফতার ভয় পায় না, ওরা লাঠিকে ভয় পায় না, ভয় পায় না বন্দুককে। ওরা বন্দুকের সামনে বুক পেতে দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করে না। ওরা পুলিশের গাড়ি থামিয়ে দিয়ে নিজের ভাইকে ছিনিয়ে আনে। ওরা শিক্ষক বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক আইনজীবী সাংস্কৃতিক কর্মী সবাইকে এক কাতারে, সবাইকে বলতে বাধ্য করেছে, সবাইকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস জুগিয়েছে। ওদের কারণে এখন সবাই কথা বলতে সাহস পেয়েছে। পথ এখন হয়ে গেছে দুইটা, অন্যায়ের বিপক্ষে নাহয় ন্যায়ের পক্ষে। এখন আর অন্য কোনো পথ যেন খোলা নেই, এই দুই পথ ব্যতীত। ওদের দেখে শিক্ষকরা বলেছেন, আমরা শিখেছি, ওদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছেন। একজন শিক্ষক তো বলেই বসলেন, আমি পিএইচডি করেও কিছুই শিখিনি, তোমাদের থেকে তার চেয়ে বেশি শিখেছি।
ওরা মুগ্ধতা ছড়াতে জানে, তাইতো মীর মুগ্ধর পানি লাগবে কিনা, বলা কথাটা যেন মানুষের মুখে মুখে উঠে গেছে, কেউ যেন এখন পানির সামনে আসলে মুগ্ধর কথা মাথায় আনতে বাধ্য। দেশের প্রায় প্রত্যেকটা মানুষকে ওরা নিজের অজান্তে হলেও কাঁদতে বাধ্য করেছে। সামান্য সিঙ্গারা বিক্রি করা একজন মানুষ ফ্রিতে সিঙ্গারা দিচ্ছে ওদের, পানি হকার ছেলেটা ফ্রিতে পানি দিয়ে যাচ্ছে। এসব কিসের কারণে? শুধুমাত্র ওদের মুগ্ধতায়। অথচ ওদের আমরা এতদিন ভুল বুঝে এসেছি, দেশের প্রত্যেকটা মানুষের ওদের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত।
এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের কথা উঠে এসেছে। আমি অবশ্য এর সাথে দ্বিমত আবার একমত! আমার কথা হচ্ছে ছাত্র রাজনীতি থাকতে হবে, কিন্তু কোন রাজনীতি? ওরা যেটা করেছে সেটা থাকবে। পৃথিবীর ইতিহাসে সকল বিপ্লবের সারথী ছিলেন ছাত্ররা। তাই ছাত্রদের রাজনীতি মানেই যে কোনো একটা দলের লেজুরবৃত্তি করতে হবে তা নয়। ছাত্ররা নিজেদের অধিকারের কথা বলবে, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য দাঁড় করাবে, এটাই হোক ছাত্ররাজনীতি। এটাই হোক ছাত্রদের মূলমন্ত্র।
ছাত্র রাজনীতি মানেই কোনো একটা দলের সদস্য হতেই হবে তা কিন্তু নয়। ছাত্র রাজনীতি তো সেটাও যেখানে কিনা ছাত্রদের অধিকার নিয়ে কথা বলে। হলের সিট ভাড়া কমানোর জন্য কাজ করে, কলেজ-ভার্সিটির বেতন কমানোর জন্য কাজ করে, আর এই ছাত্ররা যেটা করেছে সেটাই ছাত্র রাজনীতি। এই কাজ করতে গিয়ে যারা সামনে দাঁড়ায় তারাই ছাত্রনেতা। এজন্য প্রশাসনের কালো হাত ভেঙে দিতে হবে বিষয়টা তা নয়। সমঝোতা বা আলোচনা কিংবা ইতিবাচক কর্মসূচির মাধ্যমেও হতে পারে।
অনেকের কাছে ছাত্ররাজনীতি মানেই একটা দলের অন্তর্ভুক্ত হওয়া, সেই দলের সকল কার্যক্রম পালন করা, দলের নেতার কথায় ওঠা আর বসা! আসলে বর্তমানে ছাত্ররাজনীতিকেই ভুলভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ছাত্ররাজনীতির নামে একটা চাটুকার প্রজন্ম গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে।
১৯৪৮ জার্মানি-অষ্ট্রিয়ার, ১৯৫৫ সালে আর্জেন্টিনা, ১৯৫৮ সালে ভেনিজুয়েলায়, ১৯৬০ সালে কোরিয়ায়, ১৯৬৪ সালে দক্ষিণ ভিয়েতনাম ও বলিভিয়ায় ছাত্ররা গেয়েছিল জনতার গান। আমাদের দেশেও কম যায়নি ছাত্ররা। ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৯০ এই সবগুলো বিজয়েই অগ্রগামী ছিল ছাত্ররা। তাহলে এখন কেন দেশকে পিছিয়ে যাওয়ার যাত্রায় অগ্রগামী হবে ছাত্ররা।
এবার আসি আসল কথায়, পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক দেশেই অনেক সময় পুনর্গঠন বা reconstruction মুভমেন্ট হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বাধীনতার একশো বছর পরে এসে উপলব্ধি করে যে তাদের দেশের সংস্কার প্রয়োজন। ১৮৬৫ সালে দেশের পুনর্গঠনের সূত্রপাত হয়। শুধু আমেরিকায় নয়, পৃথিবীর বহু দেশে এই পুনর্গঠন হয়েছে, স্বাধীনতার বহু বছর পরে এসে এই কর্মকাণ্ড হয়েছে বিভিন্ন দেশে। অনেকেই এটা ভাবছে কিনা জানি না, আমাদের দেশে কিন্তু সেই পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। এই ছাত্রদের আন্দোলনের ফলাফল হিসেবে চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কার হয়েছে সেটা নিশ্চিতভাবেই দেশ পুনর্গঠনের একটা সূত্রপাত, সেই সূত্রপাত রূপ নিলো ষোল বছরের অনিয়ম দুর্নীতি খুন গুমের সরকারের পতনে। এই প্রক্রিয়া আশা করি চলমান থাকবে। এই উদ্যমী ছাত্ররা এরপর একে একে সকল ক্ষেত্রে অনিয়ম অসংগতি সমাধান করতে উদ্যোগ নেবে বলে আশা করি।
ছাত্রদের অনেকেই বলবে যে ছাত্র রাজনীতি ভালো না, ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের জন্য ছাত্রদের সোচ্চার করতে চাইবে। মূলত ছাত্ররা সঠিকভাবে রাজনীতি করুক, সেটা অনেকেই চায় না। বিশেষ একটা গোষ্ঠী আছে যারা ছাত্রদের মাথায় নুন রেখে কুল খেতে চায়। তারা ছাত্ররা রাজনীতি না শিখুক, ছাত্ররা রাজনীতি শিখে গেলে তারা বিপাকে পড়ে যাবে। কারণ ছাত্ররা অনিয়ম নিয়ে কথা বলবে, ন্যায়ের পক্ষে ঢাল হয়ে দাঁড়াবে, অন্যায়ের বিপক্ষে লড়বে তারা, তাই ছাত্র রাজনীতির তথাকথিত সংজ্ঞা বদলে ছাত্রদের রাজনীতিতে ঢুকতে হবে।
বর্তমান অচলাবস্থা কেটে গেলে, একটা সমাধানের দিকে গেলে, ছাত্রদের কাজ হবে, প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ সক্রিয় করার কাজে হাত দেওয়া। সেই ছাত্র সংসদের প্রতিনিধি অবশ্যই নির্বাচনের মাধ্যমে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হলগুলোতে সিট বরাদ্দ হতে হবে মেধার ভিত্তিতে। ছাত্ররা জড়াবে কোনো টেন্ডার মনোনয়ন বাণিজ্যের ধারেকাছেও। আমি বিশ্বাস করি, বর্তমান ছাত্রসমাজের মাঝে যে ঐক্য এবং শক্তি আছে ওদের দ্বারা দেশের পুনর্গঠন প্রক্রিয়া অবশ্যই সম্ভব এবং তা শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সেই বিপ্লবের মুক্তিযোদ্ধা হবে এখনকার যোদ্ধারা, শহীদের কাতারে লেখা থাকবে আবু সাইদ, মুগ্ধদের নাম। এই সংগ্রামে যারা যুক্ত হননি হয়তো তারা মাথা চাপড়াবেন আর নিজেদের কাছে নিজেদের দোষী সাব্যস্ত করবেন।
লেখক: মাহবুব নাহিদ
কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট
(খোলা কলাম বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। বিডি২৪লাইভ ডট কম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)