১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই রাজনৈতিক বেড়াজালে আটকে বার বার হোঁচট খাচ্ছে বাংলাদেশ। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ, ক্ষমতার লোভ ও ক্যুসহ নানান ধরণের আন্দোলন সংগ্রামে বার বার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক, শিক্ষা এবং সামাজিকভাবে ভেঙে পড়েছে ৩০ লাখ মানুষের আত্মত্যাগের এই দেশ। এসবের শেষ কোথায়, এর সমাধান কি?
বাকশাল গঠন করে স্বাধীনতার মাত্র ৪ বছরের মাথায় দেশের গণতন্ত্রে প্রথম আঘাত করা হয়। স্বাধীনতার কয়েক বছরের মধ্যেই এই সরকার পদ্ধতি ছিল গণতন্ত্রের প্রতি বিরাট আঘাত।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যেকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। বহু বছর বিদেশে নির্বাসনে থাকতে হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানাকে।
মুজিব হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ডানপন্থী রাজনীতি খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসে। প্রতিষ্ঠিত হয় রাজনীতির আরেকটি ধারা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ছিল বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় আঘাত।
শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অস্থিরতা এবং অনিশ্চয়তা তৈরি হয় তার ফলশ্রুতিতে ৩রা নভেম্বর সেনাবাহিনীর আরেকটি অংশ পাল্টা অভ্যুত্থান করে। ৭ই নভেম্বর পাল্টা আরেকটি অভ্যুত্থানে নিহত হন খালেদা মোশাররফ এবং আরো কয়েকজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা। সে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেন সৈনিকরা। এরপর ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন জিয়াউর রহমান।
৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানের মাধ্যমে খন্দকার মোশতাককে ক্ষমতাচ্যুত করেন মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে অফিসাররা। ১৯৭৫ সালের ৫ই নভেম্বর ক্ষমতাচ্যুত হন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। এরপর ৬ই নভেম্বর রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম।
কিন্তু ৭ই নভেম্বর পাল্টা অভ্যুত্থানের পরে বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে আসেন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান। আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম একধারে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন। এসময় জিয়াউর রহমান ছিলেন উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন।
কিন্তু এক বছর পরে ১৯৭৬ সালের ১৯শে নভেম্বর রাষ্ট্রপতি সায়েমকে সরিয়ে জিয়াউর রহমান নিজেই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়ে নেন। এর পাঁচ মাস পরেই ১৯৭৭ সালের এপ্রিল মাসে আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে সরিয়ে জিয়াউর রহমান নিজেকে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত করেন।
রাষ্ট্রপতি হবার দেড় বছরের মাথায় জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি গঠন করেন।১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক অভ্যুত্থানে নিহত হন জেনারেল জিয়াউর রহমান।
এরপরই ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল এরশাদ। জিয়াউর রহমানের মতো জেনারেল এরশাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল মধ্য-ডানপন্থী। তিনি সংবিধানে সংশোধনীর মাধ্যমে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ যুক্ত করেন।
জেনারেল জিয়া যেভাবে বিএনপি গঠন করেছিলেন, ঠিক তেমনি জেনারেল এরশাদও জাতীয় পার্টি গঠন করেন। জেনারেল এরশাদ ছিলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী সামরিক শাসক।
জেনারেল এরশাদকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। গণআন্দোলনের মুখে জেনারেল এরশাদ ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর ক্ষমতা থেকে সড়ে দাঁড়ান।
১৯৯১ সালের নির্বাচনকে মনে করা হয় বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ‘অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন’, যদিও এই নির্বাচনে পরাজিত দল আওয়ামী লীগ ‘সূক্ষ্ম কারচুপির’ অভিযোগ তুলেছিল।
এটি ছিল বাংলাদেশের পঞ্চম সংসদ নির্বাচন। এর আগে বাংলাদেশে আরো চারটি সংসদীয় নির্বাচন হলেও সেসব নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ ছিল। এই নির্বাচনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এর আগের নির্বাচনগুলো দলীয় সরকারের অধীনে পরিচালিত হয়েছিল।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে। দলের প্রধান খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালের ২০শে মার্চ বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। রাজনীতিতে আসার ১০ বছরের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী হন তিনি।
১৯৯১ সালের ৬ই অগাস্ট বাংলাদেশের সংবিধানে দ্বাদশ সংশোধনী আনা হয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে সংসদীয় ব্যবস্থার পুন:প্রবর্তন ঘটে।
বাংলাদেশের সংবিধানে যতগুলো সংশোধনী হয়েছে তার মধ্যে দ্বাদশ সংশোধনী হচ্ছে একমাত্র যেখানে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সবগুলো রাজনৈতিক দল একমত হয়েছিল। এই সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রধান। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী হন রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী।
প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রীপরিষদকে জাতীয় সংসদের নিকট দায়বদ্ধ করা হয়। এছাড়া জাতীয় সংসদের সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান চালু করা হয়।
বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকার মাঝামাঝি সময়ে মাগুরা জেলায় একটি উপ-নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে নামে। একই সাথে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সেটি সহিংসতায় রূপ নেয়। এক পর্যায়ে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামীর সদস্যরা।
আওয়ামী লীগের তরফ থেকে বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে না। রাস্তায় যখন সহিংস আন্দোলন চলছে তখন ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পথে এগিয়ে যায় বিএনপি সরকার। আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নে নির্বাচন বর্জন করলে অনেকটা ভোটার-বিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
ভোটার-বিহীন সে নির্বাচনে জয়লাভের পর আবারো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন খালেদা জিয়া। সে সংসদের প্রথম অধিবেশনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাশ করে সংবিধানে সেটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার যুক্ত হবার পরে ১৯৯৬ সালের জুন মাসে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর আবারো ক্ষমতায় ফিরে আসে।
২০০১ সালে বিএনপি সরকার আবারো ক্ষমতায় ফিরে আসার পর ২০০৭ সালের ২২শে জানুয়ারি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবারো নতুন সংকট তৈরি হয়। আওয়ামী লীগের অভিযোগ ছিল, নিজেদের পছন্দমতো সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান পাওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়স সীমা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
তীব্র রাজনৈতিক সংকটের মুখে কে এম হাসান প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করলেও সংকট কাটেনি। তখন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিজেই প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন। এতে সংকট আরো ঘনীভূত হয়।
এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টিসহ তাদের রাজনৈতিক জোট নির্বাচন বর্জনের ডাক দেয়। কিন্তু তারপরেও ২০০৭ সালের ২২শে জানুয়ারি এক তরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। এনিয়ে আন্দোলন ও সংঘাত আরো তীব্র হয়।
সংঘাতময় এক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি সেনাবাহিনী ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য করে। রাজনীতিতে সেনা বাহিনীর এই হস্তক্ষেপ করার ঘটনা ‘১-১১’ হিসেবে পরিচিতি পায়।
এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচন ও যুদ্ধপরাধীর বিচার নিয়েও দেশে ব্যাপক সহিংসতা হয়। এতে বহু মানুষ প্রাণ হারায়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বন্দ্বে দেশের বহু ক্ষতি হয়। ২০১৯ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনেও এই একই ঘটনা ঘটে। এসব নির্বাচনে একটানা চারবার প্রধানমন্ত্রী হন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।
এছাড়াও দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মতো বহু আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে এসব কারণে মূলত দেশেরই ক্ষতি হচ্ছে। অনেক মানুষের প্রাণ হানি, অর্থনৈতিক ক্ষতি, শিক্ষার গতি রোধ, সাধারণ মানুষের দুর্ভোগসহ নানান ক্ষতি হচ্ছে দেশের।
এসব অভ্যুত্থান, রাজনৈতিক সংঙ্কট সৃষ্টি না করে দেশের নাগরিক হিসেবে সবার উচিত দলমত নির্বিশেষে, বাংলাদেশকে সুন্দর একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, নির্বাচনী ব্যবস্থা সুন্দর করা, ক্ষমতার লোভ না করা। সবাই মিলে সুন্দর, পরিচ্ছন্ন একটি উন্নত বাংলাদেশ গঠন করা। তাহলেই বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। এটিই হোক দেশের প্রতিটি নাগরিকের স্বপ্ন।
মাসউদুর রহমান
লেখক ও সাংবাদিক
বাঁধন/সিইচা/সাএ