বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প গত কয়েক দশকে দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সারা বিশ্বে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থেকে এই খাত বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে এসেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে, দেশের পোশাক খাতে নতুন চ্যালেঞ্জ এবং হুমকি দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে বড় একটি অংশজুড়ে রয়েছে প্রতিবেশী দেশের ষড়যন্ত্র, যা বাংলাদেশের পোশাক খাতের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
২০১৮ সালে এশিয়ার তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৬০ শতাংশ এবং ইউরোপীয় বাজারে ৩৩ শতাংশ। ভবিষ্যতে ইউরোপীয় বাজারের এই অংশ কমে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর ফলে, চীনের রপ্তানি সম্ভাবনা সীমিত থাকার কারণে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এই সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করতে প্রতিবেশী কিছু দেশ নানা রকম ষড়যন্ত্র করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষ করে ভিয়েতনাম এবং ভারত তাদের রপ্তানি ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বাজার দখলের লক্ষ্যে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় নামছে।
প্রতিবেশী দেশের ষড়যন্ত্র: বাজার দখলের কৌশলবিশ্বের পোশাক বাজারে বড় একটি অংশ বর্তমানে বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রণ করে, যা অনেক প্রতিবেশী দেশের চোখে শূলের মতো বিঁধছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং ভিয়েতনামসহ অন্যান্য কয়েকটি দেশ ক্রমাগতভাবে বাংলাদেশের বাজারে ভাগ বসানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের পোশাক খাতের অস্থিতিশীলতাকে কাজে লাগানোর পাঁয়তারা করছে।
একাধিক কনটেন্ট ক্রিয়েটর এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ইতোমধ্যে এ বিষয়ে বক্তব্য রাখছেন, যেখানে তারা বাংলাদেশে চলমান শ্রমিক অসন্তোষ, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে ভিত্তি করে একটি নেতিবাচক চিত্র উপস্থাপন করছেন। বিশেষ করে, ভারতের কিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, কীভাবে বাংলাদেশের শ্রমিক অসন্তোষ ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ভারতের জন্য সুযোগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তারা প্রকাশ্যে বলছেন যে, বাংলাদেশে শ্রমিক অসন্তোষ ও ক্রেতাদের কার্যাদেশে মন্দাভাব ভারতের পোশাক শিল্পের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে।
ভিয়েতনামের কৌশল: মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি ও বাজার দখলের প্রয়াসভিয়েতনাম ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষর করেছে, যার ফলে ২০২৭ সালের পর থেকে তাদের পণ্যের ওপর কোনো শুল্ক থাকবে না। এটি ভিয়েতনামের জন্য ইউরোপীয় বাজারে একটি বড় সুবিধা। আর বাংলাদেশ যদি ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটে তবে ২০২৯ সাল পর্যন্ত ইউরোপীয় বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত থাকবে, তারপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপিত হবে। এই অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে ভিয়েতনাম ইউরোপীয় বাজারের একটি বড় অংশ নিজেদের দিকে টানার জন্য কাজ করছে।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প শুধু দেশের অর্থনীতির জন্য নয়, লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, শ্রমিক অসন্তোষ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা। প্রতিবেশী দেশের ষড়যন্ত্র এবং তাদের কৌশল মোকাবিলায় আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকা জরুরি।
এখানে ষড়যন্ত্রের একটি সুস্পষ্ট দিক দেখা যায়, যেখানে ভিয়েতনাম কৌশলগতভাবে বাংলাদেশকে ইউরোপীয় বাজার থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চায়। আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক পর্যায়েও তাদের এই প্রভাব কাজে লাগানোর চেষ্টা চলছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে গেলে আন্তর্জাতিক ২৭টি কনভেনশনের শর্ত পূরণের প্রয়োজন। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ মূলত এসব কনভেনশন নয়, বরং ভিয়েতনামের প্রভাব খাটিয়ে বাংলাদেশকে বাইরে রাখার চেষ্টাই মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে।
চীনের সাথে মার্কেট শেয়ারের লড়াই এবং ভারতীয় প্রচারণা২০১১ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে চীনের মার্কেট শেয়ার ছিল ৩০ শতাংশ, যা এখন কমে ২০ শতাংশ হয়েছে। চীনের এই হারানো বাজারের বড় অংশটাই বাংলাদেশ দখল করতে সক্ষম হয়েছে। তবে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনের শেয়ার ৪০ শতাংশ থেকে কমে ৩০ শতাংশের নিচে নেমেছে। এই পরিস্থিতিতে, চীন ও ভারতের সাথে বাজার শেয়ার নিয়ে লড়াই আরও কঠিন হয়ে উঠছে।
ভারতের কিছু প্রচার মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ভিডিও এবং পোস্টের মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের এই বাজার দখল করার সুযোগকে উৎসাহ দিচ্ছে। এতে একদিকে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা বাংলাদেশের পোশাক খাত সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পেতে পারে এবং অন্যদিকে ভারতীয় পোশাক শিল্প লাভবান হতে পারে।
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং শ্রমিক অসন্তোষের সুযোগে ষড়যন্ত্রবাংলাদেশের পোশাক খাতে শ্রমিক অসন্তোষ একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি বিদেশি ক্রেতাদের কার্যাদেশ প্রায় ১০ শতাংশ কমেছে এবং অনেক বিদেশি ক্রেতা সফর পিছিয়ে দিয়েছেন বা বাতিল করেছেন। দেশজুড়ে শ্রমিক অসন্তোষ এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে এই অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলো নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা করছে।
সম্প্রতি সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং মেজর জেনারেল মুহাম্মদ মো. মঈন খান এক মতবিনিময় সভায় বলেন, এই অস্থিরতার প্রধান কারণ হলো বহিরাগতদের উসকানি। শ্রমিকদের দাবি এবং ঝুট বাণিজ্য দখল নিয়ে দ্বন্দ্ব। এসব সমস্যা প্রতিবেশী দেশগুলোর দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রতিবেশী দেশের ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সচেতন থাকতে হবে:বাংলাদেশের পোশাক শিল্প শুধু দেশের অর্থনীতির জন্য নয়, লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, শ্রমিক অসন্তোষ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা। প্রতিবেশী দেশের ষড়যন্ত্র এবং তাদের কৌশল মোকাবিলায় আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকা জরুরি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক স্থান ধরে রাখতে এবং ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে বাংলাদেশকে আরও সতর্ক এবং দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: পরিচালক, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ স্ট্র্যাটেজিক স্ট্র্যাটেজিস।
এইচআর/জেআইএম