হাঁপানির কষ্ট থেকে এবার মুক্তি!
ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) বা হাঁপানি বর্তমান নগরকেন্দ্রীক জীবনযাত্রার অন্যতম বড় সমস্যা। সিওপিডিতে আক্রান্ত হলে
রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়া, শ্বাসনালী বন্ধ হয়ে যাওয়া, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসা, প্রদাহের মতো নানা সমস্যা হতে পারে। নিয়মিত ধূমপান করলে, ক্ষতিকারক বায়ুকণার সংস্পর্শে দীর্ঘ দিন থাকলে তার প্রভাবে সিওপিডিতে আক্রান্ত হতে পারেন অনেকেই।
২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘গ্লোবাল বার্ডেন অফ ডিজিজ’ স্টাডির একটি রিপোর্ট অনুসারে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ২১ কোটি ২০ লক্ষের বেশি মানুষ সিওপিডি রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে ভারতেই প্রায় ৫ কোটি ৫০ লক্ষ বেশি সিওপিডির রোগী রয়েছে। সেই রিপোর্ট অনুসারে যে সব রোগে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে, তার মধ্যে দ্বিতীয় বড় কারণই হল এই সিওপিডি।
প্রতিদিন অক্সিজেন নেওয়া, ইনহেলেশন থেরাপি (ইনহেলার ব্যবহার), বাইপাপের মতো নানা চিকিৎসা পদ্ধতির প্রচলিত আছে সিওপিডির রোগীদের সুস্থ রাখতে। এই সব পদ্ধতি একদিনে যেমন ঝক্কির অন্যদিকে তেমনই খরচ সাপেক্ষ। তবে এই সব পদ্ধতি ছাড়াও সুস্থ থাকার আরও একটি উপায় রয়েছে। পালমোনারি রিহ্যাবিলিটেশন হল তেমনই একটি পদ্ধতি। এটি সিওপিডির প্রভাব কমিয়ে রোগীকে সুস্থ থাকতে সাহায্য করে।
তবে এই পদ্ধতি খুব কার্যকরী হলেও, এর ব্যবহার অত্যন্ত কম। ‘বিশ্ব সিওপিডি দিবসে’ ফুসফুসকে ভাল রাখতে ও সুস্থ সবল সমাজ গড়ে তুলতে তাই কলম ধরলেন প্রখ্যাত পালমোনোলজিস্ট অংশুমান মুখোপাধ্যায়।
পালমোনারি রিহ্যাবিলিটেশন আসলে কী?
সিওপিডির প্রভাব কমিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস ক্ষমতা আরও উন্নত করে তোলার এক দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতি এই পালমোনারি রিহ্যাবিলিটেশন বা ফুসফুসের পুনর্বাসন। ৬-৮ সপ্তাহ ধরে রোগীকে নানা ব্যায়াম শেখানো হয়, জীবনধারাতেও আনা হয় নানা পরিবর্তন। এই পদ্ধতি শ্বাস-প্রশ্বাসের বিভিন্ন কৌশল শেখায় যা শ্বাসকষ্ট কমাতে পারে, শারীরিক কার্যকলাপ বাড়াতে সক্ষম এমনকি মনের স্বাস্থ্য ভাল রাখতে পারে। পালমোনারি রিহ্যাবিলিটেশনের নিয়ম মেনে চললে কেবল জীবনযাত্রার মান বাড়ানো সম্ভব বা ফুসফুসের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে এমনটা নয়। ঘন ঘন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া থেকে দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয়তাও কমে।
ফুসফুসের কার্যকারিতা উন্নত করার জন্য পালমোনারি রিহ্যাবিলিটেশন পদ্ধতিতে নিয়মিত ব্যায়াম করার বিষয়ে বিশেষ জোর দেওয়া হয়। এর ফলে মনের স্বাস্থ্য ভাল থাকার পাশাপাশি মেজাজ স্থিতিশীল থাকে, কার্ডিওভাসকুলার স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে। এই পদ্ধতিতে বিশেষ ট্রেনিং প্রাপ্ত ফিজিওথেরাপিস্টরা রোগীর শারীরিক অবস্থা বুঝে তাঁর দৈনন্দিন জীবনে নানা পরিবর্তন আনেন। পালমোনারি রিহ্যাবিলিটেশন মূলত কয়েকটি উপাদানের উপর নির্ভরশীল। সেগুলি হল-
১। ব্যায়াম: সহনশীল ব্যায়াম যেমন হাঁটা বা সাইকেল চালানো, আবার পেশীর কার্যকারিতা, স্ট্যামিনা বাড়ানোর জন্য স্ট্রেন্থ ট্রেনিং করানো হয়। সময়ের সঙ্গে এই ব্যায়ামগুলিই রোগীদের শ্বাসকষ্ট কমাতে এবং শারীরিক কার্যকলাপের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে।
২। শ্বাস-প্রশ্বাসের কৌশল শেখানো: পার্সড-লিপ শ্বাস নেওয়া এবং ডায়াফ্রাম্যাটিক শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো পদ্ধতিগুলি ফুসফুসের ক্ষমতা বাড়াতে এবং শ্বাসকষ্ট নিয়ন্ত্রণে রাখতে শেখায়। এই কৌশলগুলি রোগীদের দৈনন্দিন জীবন আরও সহজ করে তোলে।
৩। শিক্ষা এবং কাউন্সেলিং: পালমোনারি রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রামগুলি রোগীদের সিওপিডি বিষয়ে শিক্ষিত করে তোলে। ওষুধের ব্যবহার, অক্সিজেন থেরাপি, এবং শ্বাসকষ্টের সাথে মোকাবিলা করার কৌশল শেখানো তার মধ্যে অন্যতম। রোগীরা তাদের স্বাস্থ্যের দায়িত্ব নিতে এবং অবস্থা কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে শেখে।
৪। মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি: সিওপিডি অনেক সময় উদ্বেগ এবং বিষন্নতার দিকে রোগীকে ঠেলে দেয়। পালমোনারি পুনর্বাসন রোগীদের মানসিক চাপ পরিচালনা করতে এবং একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখতে সাহায্য করে।
কেন পালমোনারি রিহ্যাবিলিটেশন গুরুত্বপূর্ণ?
সিওপিডি একটি প্রগতিশীল রোগ। এই রোগে আক্রান্তদের অবস্থা হঠাৎ হঠাৎ খারাপ হতে পারে। ঘন ঘন হাসপাতালে ভর্তি করতে হতে পারে। ক্রমে ক্রমে সময়ের সঙ্গে যা একটি চক্রে পরিণত হয়। পালমোনারি রিহ্যাবিলিটেশন রোগীদের অবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে এই চক্র ভাঙতে সাহায্য করে।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে, পালমোনারি রিহ্যাবিলিটেশন অসুস্থ হওয়ার ক্রমবর্ধমান হার কমায়। বর্ধিত শারীরিক সহনশীলতা, উন্নত শ্বাস-প্রশ্বাসের কৌশল এবং মনস্তাত্ত্বিক সহায়তার মাধ্যমে, এই পদ্ধতি সিওপিডি রোগীদের স্বাস্থ্যের সামগ্রীক উন্নতি ঘটায়।
মনে রাখতে হবে, পালমোনারি রিহ্যাবিলিটেশন সিওপিডির কোনও দ্রুত সমাধান নয়। ফুসফুসের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য নিজের কাছে নিজের প্রতিশ্রুতি। এই পদ্ধতি শ্বাসকষ্ট কমাতে, ব্যায়ামের মাধ্যমে ফুসফুসের ক্ষমতা বাড়াতে কার্যকরী। তবে সাফল্য নির্ভর করে রোগীর, নির্ধারিত ব্যায়াম এবং কৌশলগুলি অনুসরণ করার উপরেই।
এই পদ্ধতিতে রোগীদের গাইড করার ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যদিও এই পদ্ধতি সিওপিডি নিরাময় করতে পারে না, তবে রোগীর অবস্থা বুঝে তাঁর জীবনযাত্রায় পরিবর্তনের মাধ্য়মে রোগের প্রভাব কমাতে উপযোগী।