রাজধানীসহ সারাদেশে পরিবেশ দূষণ, নদী ভরাটসহ নানাবিধ ইস্যুতে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিটের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময়ে আদেশ ও রায়ের ঘোষণা এসেছে। তবুও থামছে না দূষণ। পরিবেশ অধিদপ্তর ও প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা আদেশ প্রতিপালন করায় ভারসাম্য রক্ষা বা দূষণ কিছুটা কমলেও অপতৎপরতায় ফের বিপর্যয় বা দূষণ ঘটতে থাকে। প্রশাসন এ বিষয়ে আরও উদ্যোগী হলে পরিবেশ দূষণ কমানো সম্ভব বলে মনে করেন আইনজীবী ও পরিবেশ বিষয়ক গবেষকরা।
বায়ুদূষণ, নদীদূষণ, শব্দদূষণ রোধে হাইকোর্টের নির্দেশনার আলোকে কাজ করে আসছে পরিবেশ অধিদপ্তর, সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর। বায়ু ও পরিবেশ দূষণ রোধে সবশেষ অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ না হওয়ায় ব্যাখ্যা জানাতে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক, পরিবেশ অধিদপ্তরের দুই কর্মকর্তাসহ তিনজনকে গত ১৭ মে তলব করেন হাইকোর্ট। তাদের ৩১ মে আদালতে হাজির হতে বলা হয়। কিন্তু ওইদিন তারা উপস্থিত হলেও এ বিষয়ে শুনানি হয়নি। হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চের জুনিয়র বিচারপতি ছুটিতে ছিলেন। এরপর বিষয়টি শুনানির জন্য আবারও পিছিয়ে যায় বলে জানান রিটকারী আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ।
পরিবেশদূষণ রোধে আদালতের আদেশ, সরকারি উদ্যোগ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কাজের অগ্রগতি নিয়ে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ক্যাম্পাসনিউজকে বলেন, পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কিত বায়ু, পানি, মাটি যে কোনো একটি দূষিত হলেই পরিবেশদূষণ ঘটে।
তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা শহর যখন বিশ্বে এক নম্বর বায়ুদূষণের শহরে পরিণত হলো তখন হাইকোর্টে আমরা আলাদাভাবে রিট পিটিশন করেছিলাম। যেখানে আদালত ৯ দফাসহ বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন।’
মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘আমরা যখন আদালত অবমাননার অভিযোগ আনি তখন দেখা যায়, প্রশাসন কিছু কাজ করে এবং আদালতে এসে তারা জবাব দেন আমরা এসব নিয়ে কাজ করেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো তারা যে অগ্রগতি সাধন করেন কয়েকদিন পরেই সেই অগ্রগতি আবার ব্যাকসাইটে চলে যায়। বায়ুদূষণের কারণে যে ইটভাটা বন্ধ করা হয়, কয়েকদিন পরে আবারও চালু হয়। এ জায়গায় মনিটরিং থাকে না। ২০১৯ সাল থেকে রাজধানীসহ ঢাকার আশপাশে বহু ইটভাটা বন্ধ করা হয়। কিন্তু খোঁজখবর নিয়ে দেখবেন যে এখন আবার অধিকাংশই চালু আছে। এই যে টালবাহানা, কানামাছি খেলা, এগুলো বন্ধ করার জন্য প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আইন আছে, নিয়ম রয়েছে, সরকারের নীতিমালা আছে, তারপরও পরিবেশদূষণ রোধ করা যাবে না? সবকিছু মিলে এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, যে আদেশগুলো হয়, তার কিছু বাস্তবায়ন হয়, আবার কিছু বাস্তবায়ন হয় না।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আমাতুল করীম বলেন, ‘আমি পরিবেশ ও বায়ুদূষণকে দুই ভাবে দেখি। নাগরিক হিসেবে আমার একটা চাওয়া আছে, প্রত্যাশা আছে যে পরিবেশটা কি রকম হওয়া উচিত? আবার, আমি যখন পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন আইনজীবী তখন আমি তাদের বিষয়গুলো অন্য পরিপ্রেক্ষিতে দেখি।
তিনি বলেন, ‘ধরেন দেশে পরিবেশ রক্ষা, পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন ধরনের কাজ আইন করে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশেষ করে পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই দায়িত্বটা দেওয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু দায়িত্ব পালনের জন্য যে যন্ত্রপাতি প্রয়োজন সেটি কিন্তু দেওয়া হয়নি।
তিনি বলেন, আইন আছে প্রয়োগ করতে হবে। সবার আগে লোকবল ও সরঞ্জাম বাড়াতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, নাগরিকদের সচেতন হতে হবে।
আমাতুল করীম আরও বলেন, পরিবেশের আইন কিন্তু সুন্দরভাবেই আছে। আমরা তা মানছি না। অবৈধ ইটভাটা কে নিয়ন্ত্রণ করবে। ডুয়েল রুল পলিসি চলে এসেছে। জেলা প্রশাসক ইটভাটা নিয়ে কাজ করেন। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র দেখে তাদের অনুমোদন দিতে হবে।’
সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী বলেন, ‘আমরা যদি আজ থেকেই সচেতনতা বাড়াই, তো কাজ শুরু হয়ে যাবে। আমি, আপনি একা উদ্যোগ নিলে হবে না, সবাই মিলে যখন এটিকে একই উপলব্ধিতে নিয়ে আসবো তখন আমাদের দেশেও একদিন সুন্দর পরিবেশ বিস্তার করবে।’
তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, ‘যদি একটু নেম ভবনের আশপাশে যান, মনটা জুড়িয়ে যাবে গাছগাছালি দেখে। আর পাশেই অন্য একটি রোডে যখন দেখেন সেটি ময়লা-আবর্জনায় ভরা। নিশ্চয়ই সেখানে মনিটরিংয়ের অভাব।’
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার ক্যাম্পাসনিউজকে বলেন, পরিবেশ হলো সর্বজনীন বিষয়। পরিবেশ দূষণে স্বল্প বা বেশি সবার ভূমিকা থাকে। প্রত্যেক মানুষ তার জীবনচক্রে কত আবর্জনা, বর্জ্য তৈরি করছে, কার্বন ডাই অক্সাইড তৈরি করছে। বসতি তৈরির জন্য গাছ কাটছে। প্রতিটা মানুষই পরিবেশদূষণ করছে তার জন্য মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবার মানুষই এটা সংরক্ষণের জন্য কথা বলছে, কাজ করছে। এটা চলমান প্রক্রিয়া। পরিবেশ সংরক্ষণ ও পরিবেশ উন্নয়ন এ প্রক্রিয়ায় যখন অসহনীয় কোনো কিছু হয়ে যায় তখনই কোনো সংগঠন, সংস্থা বা উচ্চ আদালতের নজরে আসে। আবার আদালতে না গিয়েও বিভিন্ন পরিবেশ সংরক্ষণ সংগঠনের পক্ষ থেকে কাজ করা হয়।
এই পরিবেশবিদ আরও বলেন, এখন শুধু আইনের প্রয়োগ করে পরিবেশ সংরক্ষণ বা দূষণ রোধ সম্ভব হবে না। যতক্ষণ না জনসচেতনতা তৈরি হয়। অনেক সময় দেখা যায়, প্রত্যেকে তার জায়গা থেকে তাদের পক্ষে সাফাই গাইবে। এভাবে শুধু পারস্পরিক সংঘর্ষই হবে, সমাধান হবে না। এখন আমাদের সচেতনতা যেমন দরকার অন্যদিকে আইন জানা এবং অনুকরণ দরকার। ধরুন, একটি পুকুর আছে কারও। এটির মালিক জানেন যে এটা তার পুকুর, তিনি তার মতো করে শ্রেণি পরিবর্তন করবেন। কিন্তু এটা যে আইনে নেই সেটি কিন্তু অনেকেই জানেন না। প্রাকৃতিক জলাধার আইন কিংবা পানি আইন কিংবা পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে তিনি চাইলেই পুকুর ভরাট করতে পারবেন না। এ কারণে পরিবেশ আইন জানাটাও বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এফএইচ/এসএনআর/জেআইএম